বুদ্ধ যেভাবে জাতিভেদের বক্ষে কুঠারাঘাত করেছিলেন

 


জাতিভেদের ফলে ভারতবর্ষের মানুষেরা যে দীর্ঘদিন ধরে দুর্গতির শিকার হয়েছিল, তা সর্বজনবিদিত। প্রতারক ব্রাহ্মণরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে বাকি বর্ণকে নিকৃষ্ট বলে প্রতিপন্ন করতো। কোনো ব্যক্তি যে জাতিতে জন্মেছে তার থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, ইচ্ছমত জীবিকা গ্রহণ করে বাঁচার স্বাধীনতা মানুষের ছিল না, সংস্কারহীন গতিহীন বদ্ধ জলাশয়ের মত দূষিত হয়ে পড়েছিল সমাজ, শূদ্র এবং অস্পৃশ্যদের প্রতি সীমাহীন অবিচার  তৎকালীন কলুষিত সমাজের বিধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ভারতবর্ষের এমন চরম দুর্গতির দিনে মহাত্মা বুদ্ধ আলোকবর্তিকা হাতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি সকল বিভেদের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়েছিলেন, নিপীড়িতের কষ্ট তার করুণা দিয়ে দূর করেছিলেন। তিনি বারবার তার যুক্তি দ্বারা মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জাতিভেদের অসারতা। জাতিভেদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামের কথা  ত্রিপিটকের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। মহামতি বুদ্ধের এই মহৎ দিকটির বর্ণনা থাকছে বর্তমান লেখাটিতে।

জন্ম দ্বারা নয়, কর্ম দ্বারাই কেউ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি হয়

একসময় বুদ্ধ ইচ্ছানঙ্গল গ্রামের কাছে ইচ্ছানঙ্গল বনে অবস্থান করছিলেন। সেইসময় অনেক বিখ্যাত ব্রাহ্মণ ইচ্ছানঙ্গল গ্রামে থাকতেন। তাদের মধ্যে বাসিষ্ঠ ও ভরদ্বাজ এই দুই তরুণ ব্রাহ্মণদের মধ্যে ‘মানুষ জন্মের কারণে শ্রেষ্ঠ হয় নাকি কর্মের কারণে শ্রেষ্ঠ হয়?’ এই নিয়ে তর্ক দানা বাধে।

ভরদ্বাজ বলেন, ” হে বাসিষ্ঠ, যার মাতৃবংশ ও পিতৃবংশ সাত পুরুষ পর্যন্ত শুদ্ধ আছে, যার কুলে সাতপুরুষ পর্যন্ত বর্ণসঙ্কর হয়নি সেই ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ।”

বাসিষ্ঠ বলেন, ” হে ভরদ্বাজ! যে মানুষ শীল সম্পন্ন ও কর্তব্য পরায়ণ তাকেই ব্রাহ্মণ বলা উচিত।”

এই বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে ভীষণ তর্ক চলতে থাকে। কিন্তু তারা পরস্পর কোনো সন্তোষজনক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। শেষে বাসিষ্ঠ বলেন, ” হে ভরদ্বাজ, আমাদের এই তর্কবিতর্ক এখানে মিটবে না। আমাদের গ্রামের কাছে শ্রমণ গৌতম বাস করছেন। তিনি বুদ্ধ, পুজ্য এবং সর্বলোকের গুরু বলে প্রসিদ্ধি আছে। চলো তার কাছে গিয়ে আমাদের বিবাদের কথা জানাই। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা তাই মেনে নেব।”

এরপর দুজন বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হন। বাসিষ্ঠ বুদ্ধকে বলেন, ” হে গোতম, আমরা দুজন শিক্ষিত ব্রাহ্মণপুত্র। ও তারুক্ষের শিষ্য, আমি পৌকরসাদির শিষ্য। আমাদের মধ্যে জাতিভেদ নিয়ে এক বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। ভরদ্বাজ বলছে, জন্মদ্বারাই মানুষ ব্রাহ্মণ হয় কিন্তু আমি বলি মানুষ কর্ম দ্বারাই ব্রাহ্মণ হয়। আপনিই বলুন যথার্থ ব্রাহ্মণ ঠিক কিভাবে হওয়া যায়?  আমরা আপনার কীর্তির কথা শুনেছি, তাই আপনার কাছে এলাম। আপনি আমাদের এই বিতর্কের সমাধান করুন।”

তাদের কথা শুনে বুদ্ধ বলেন,  হে বাসিষ্ঠ, তৃণ, বৃক্ষ প্রভৃতি বনস্পতিদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জাতি দেখতে পাওয়া যায়। তেমনি পোকা, পিঁপড়া প্রভৃতি ছোটো ছোটো প্রাণীদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন জাতি দেখতে পাওয়া যায়। সর্প, শ্বাপদ, জলচর , মৎস্য এবং আকাশগামী পাখিদের মধ্যেও অনেক জাতি আছে। তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চিহ্ন বর্তমান, যার মাধ্যমে তাদের আলাদা বলে চেনা যায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে এমন পার্থক্য দেখা যায় না। চুল, কান, চোখ, মুখ, নাক, ঠোঁট, ভ্রু, ঘাড়, পেট, পিঠ, হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গে এক মানুষের সাথে অন্য মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং পশুপাখিদের মধ্যে যেমন আকার-আকৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন জাতি দেখতে পাওয়া যায়, তেমন মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। সব মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একইরকম বলে মানুষের মধ্যে জাতিভেদ নির্ধারণ করা যায় না। কিন্তু মানুষের জাতি কর্ম দ্বারা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

যদি কোনো ব্রাহ্মণ গোপালন করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাহলে তাকে গোয়ালা বলবে, ব্রাহ্মণ নয়। যে শিল্পকলার দ্বারা জীবিকা অর্জন করে, সে কারিকর, ব্রাহ্মণ নয়। যে ব্যবসা করে সে বণিক, ব্রাহ্মণ নয়। যে দূতের কাজ করে সে দূত, ব্রাহ্মণ নয়। যে চুরিদ্বারা জীবিকা অর্জন করে সে চোর, ব্রাহ্মণ নয়। যে যুদ্ধ দ্বারা জীবিকা অর্জন করে সে যোদ্ধা, যে যাগযজ্ঞের দ্বারা জীবিকা অর্জন করে সে যাজক এবং যে রাজ্যদ্বারা জীবিকা অর্জন করে সে রাজা। কিন্তু এদের মধ্যে কাউকেও কেবলমাত্র জন্মের কারণে ব্রাহ্মণ বলা যাবে না।

যিনি সংসারের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে, সংসারের দুঃখকে ভয় করেন না, যার কোনো ব্যাপারেই কিছুমাত্র আপত্তি নেই, তাকেই আমি ব্রাহ্মণ বলি। অন্যের দেওয়া গালি, অন্যের লোকসান ও অসুবিধা যিনি সহ্য করেন, ক্ষমাই যার বল তাকেই আমি ব্রাহ্মণ বলি। যিনি পদ্মপাতায় জলের মত, যিনি ইহলোকের বিষয়সুখ হতে অলিপ্ত থাকেন, তাকেই আমি ব্রাহ্মণ বলি।

“জন্মেতে ব্রাহ্মণ নহে, নাহি হয় জন্মে অব্রাহ্মণ,

কর্মেতে ব্রাহ্মণ হয়, কর্মবশে হয় অব্রাহ্মণ।

কৃষক কর্মেতে হয়, শিল্পি হয় কর্মের কারণ,

বণিক কর্মেতে হয়, প্রেষ্য হয় কর্ম নিবন্ধন।

চোর হয় কর্মহেতু, যোদ্ধা জীব কর্মের কারণ,

যাচক কর্মেতে হয়, রাজা হয় কর্ম নিবন্ধন।

কর্ম আর ফলজ্ঞানী প্রতীত্য সমুৎপাদ দর্শীগণ,

পণ্ডিতেরা এই কর্ম যথাভূত করে নিরীক্ষণ।

কর্মেতে চলেছে বিশ্ব, কর্মহেতু ভ্রমে প্রাণীগণ,

আণিবদ্ধ রথচক্র সম ঘুরে কর্মে জীবগণ।

তপস্যায় ব্রহ্মচর্যে সংযমে ও ইন্দ্রিয় দমনে,

ইহাতে ব্রাহ্মণ হয়, ব্রাহ্মণ উত্তম শুধু গুণে। ”

বুদ্ধের এই উপদেশ শুনে বাসিষ্ঠ ও ভরদ্বাজ বুদ্ধের শরণ নিলেন।

[সুত্তপিটক\মজ্ঝিমনিকায়\ব্রাহ্মণবর্গ\ বাসেট্ঠসুত্ত]

ব্রাহ্মণ কিভাবে হয়?

বুদ্ধ জাত্যাভিমানী ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেনঃ

“জটা, গোত্র বা জাতির পরিচয়ে কেউ ব্রাহ্মণ হয় না। যার অন্তরে সত্য ও ধর্ম বিরাজমান তিনিই পবিত্র, তিনিই ব্রাহ্মণ।”

“হে নির্বোধ, তোমার জটা বা মৃগচর্ম ধারণে কি হবে? তোমার অন্তঃকরণ ক্লেদপূর্ণ, তুমি শুধু বাইরে মার্জনা করছ।”

“জাতি বা মায়ের পরিচয়ে ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না। সে আমি ব্রাহ্মণ এরূপ নাম কীর্তন করে বৃথাই অহংকার করে। যিনি অনাসক্ত ও নিষ্পাপ তিনিই ব্রাহ্মণ পদবাচ্য।”

ধম্মপদে সম্পূর্ণ একটি অধ্যায় জুড়ে বুদ্ধের এসকল কথা পাওয়া যাবে। একটি স্বতন্ত্র লেখায় পূর্বেই ধম্মপদের বাণীগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যারা আগ্রহী তারা ওই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেনঃ বুদ্ধের চোখে প্রকৃত ব্রাহ্মণ কে?

একই রকমের কথা সংযুক্তনিকায়ের ব্রাহ্মণ সংযুক্তের শুদ্ধিক সূত্রে আছে। এখানে ভরদ্বাজ নামে এক ব্রাহ্মণকে বুদ্ধ বলেছেন, ” যার অন্তর কলুষিত, যে পাপকর্মে লিপ্ত, সে অনেক প্রলাপ বকলেও (ব্রাহ্মণ মাত্রই শুদ্ধ হয় এমন প্রলাপ) জন্ম দ্বারা ব্রাহ্মণ হয় না। ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, চণ্ডাল বা ঝাড়ুদার যেই হোক না কেন সে যদি সদাচারসম্পন্ন হয়, তাহলে সেই পরম শুদ্ধি লাভ করে। ”

ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণে কোনো ভেদ নেই

একবার বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডকের বাগানে অবস্থান করছিলেন। তখন বিভিন্ন দেশ থেকে কোনো কারণে ৫০০ ব্রাহ্মণ শ্রাবস্তীতে আগমন করেছিলেন। কথোপকথনকালে তাদের মধ্যে একটি প্রশ্ন ওঠে, ” শ্রমণ গৌতম বলেন চার বর্ণই মোক্ষ লাভ করতে পারবে। তার সাথে তর্ক করে কে তার মতের খণ্ডন করবে?” অবশেষে তারা আশ্বলায়ন নামে এক ব্রাহ্মণপুত্রকে এই কাজে নিযুক্ত করবেন বলে স্থির করেন।

আশ্বলায়নের পড়াশোনা সবে মাত্র শেষ হয়েছিল। তিনি নিঘন্টু, ছন্দশাস্ত্র ইত্যাদি বেদাঙ্গের সাথে বেদও শিখেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধের সাথে তর্ক করা যে সহজ নয় তা তিনি ভালোভাবেই জানতেন। বুদ্ধের সাথে তর্ক করার জন্য যখন তাকে বাছাই করা হল তখন তিনি ঐ ব্রাহ্মণদের বললেন, “দেখুন, শ্রমণ গোতম ধার্মিক লোক, এবং ধার্মিক লোকের সাথে তর্ক করা সহজ নয়। যদিও আমি সকল বেদে পারদর্শী হয়েছি, কিন্তু গোতমের সাথে তর্ক করার ক্ষমতা আমার নেই।”

আশ্বলায়নের সাথে অনেক কথা কাটাকাটি করার পর ব্রাহ্মণেরা আশ্বলায়নকে বললেন, “দেখ আশ্বলায়ন, তুমি বুদ্ধের ধর্ম অধ্যয়ণ করেছ, তাই যুদ্ধ ছাড়াই পরাজয় স্বীকার করা তোমার উচিত হচ্ছে না। ”

একথা শুনে আশ্বলায়ন বললেন, “যদিও গোতমের সাথে তর্ক করা কঠিন, তবুও আপনারা যখন এত করে বলছেন আমি আপনাদের সাথে আসছি।”

এরপর আশ্বলায়ন সেই ব্রাহ্মণদের সাথে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হলেন। আশ্বলায়ন বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, ” হে গোতম, ব্রাহ্মণরা বলে যে ব্রাহ্মণবর্ণই শ্রেষ্ঠ, অন্যান্য বর্ণ নীচ; ব্রাহ্মণবর্ণই শুক্ল, অন্যান্য বর্ণ কৃষ্ণ; ব্রাহ্মণরাই মোক্ষ লাভ করে, অন্যরা করে না। ব্রাহ্মণ ব্রহ্মদেবের মুখ হতে উৎপন্ন হয়েছে, তারা তার ঔরসপুত্র; এজন্যই তারা ব্রহ্মদেবের উত্তরাধিকারী। হে গোতম ঐ সম্বন্ধে আপনার মত কি?”

বুদ্ধ- হে আশ্বলায়ন, ব্রাহ্মণদের মেয়েরা ঋতুমতী হয়, তারা গর্ভে সন্তান ধারণ করে, তারা প্রসব করে, আর তারা নিজের সন্তানকে স্তন পান করায়। এভাবে ব্রাহ্মণের সন্তান অন্যান্য বর্ণের মতই মাতৃগর্ভ হতে জন্ম নেয়। এরপরেও যদি ব্রাহ্মণেরা বলে যে তারা ব্রহ্মদেবের মুখ হতে উৎপন্ন হয়েছে, তাহলে তা আশ্চর্যের নয় কি?

আশ্বলায়ন- হে গোতম, আপনি যাই বলুন না কেন, ব্রাহ্মণ ব্রহ্মদেবের উত্তরাধিকারী। ব্রাহ্মণেরা একথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন।

বুদ্ধ- হে আশ্বলায়ন যবন, কম্বোজ প্রভৃতি সীমান্ত প্রদেশগুলিতে কেবল আর্য ও দাস এই দুটি বর্ণ বাস করে, সেখানে কখনো আর্য দাস হয় এবং দাস আর্য হয়, একথা তুমি শুনেছ কি?

আশ্বলায়ন- হ্যাঁ, আমি একথা শুনেছি।

বুদ্ধ- যদি এই কথা সঠিক হয়, তাহলে ব্রহ্মদেব যে ব্রাহ্মণদের মুখ হতে উৎপন্ন করেছিলেন এবং তারা যে সর্ববর্ণের শ্রেষ্ঠ, একথার ভিত্তি কি?

আশ্বলায়ন- আপনি যাই বলুন, ব্রাহ্মণদের দৃঢ় বিশ্বাস যে তারাই সর্ববর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আর অন্যান্য বর্ণরা তাদের তুলনায় হীন।

বুদ্ধ- ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কিংবা শূদ্র যদি প্রাণিহত্যা, চুরি, ব্যাভিচার, মিথ্যা-ভাষণ, প্রতারণা, গালাগালি, বৃথাভাষণ ইত্যাদি করে, যদি অন্যের ধনের উপর লোভ রাখে, যদি অপরকে দ্বেষ করে, তাহলে শুধু তারাই মৃত্যুর পর নরকে যাবে। ব্রাহ্মণেরা যদি এসব খারাপ কাজ করে তবে তারা নরকে যাবে না। তুমি কি একথা মনে কর?

আশ্বলায়ন- হে গোতম, যে কোনো বর্ণের মানুষই হউক না, সে যদি এইসব পাপকর্ম করে তাহলে মৃত্যুর পর সে নরকে যাবে। ব্রাহ্মণ হলেই বা কি, আর অব্রাহ্মণ হলেই বা কি, সকলকে নিজ নিজ পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হয়।

বুদ্ধ- যদি কোনো ব্রাহ্মণ প্রাণনাশ হতে নিবৃত্ত হয়, চুরি, মিথ্যাকথন, প্রতারণা, গালাগালি, বৃথাপ্রলাপ, পরদ্রব্যে লোভ, দ্বেষ এসব পাপ হতে নিবৃত্ত হয় তাহলে শুধু সেই মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবে কিন্তু ক্ষত্রিয় , বৈশ্য বা শূদ্ররা যাবে না, একথা কি তুমি মনে কর?

আশ্বলায়ন- যে কোনো বর্ণের ব্যক্তিই যদি এইসব পাপকার্য হতে বিরত থাকে তাহলে সে স্বর্গে যাবে। পুণ্যের ফল ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণ সকলেই সমানভাবে পাবে।

বুদ্ধ-  শুধু ব্রাহ্মণরাই বিদ্বেষ ও শত্রুতা ত্যাগ করে মৈত্রী ভাবনা পোষণ করতে পারে, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র তা পারে না, একথা তুমি কি মনে কর?

আশ্বলায়ন- চার বর্ণের মানুষেরাই মৈত্রী ভাবনা পোষণ করতে পারে।

বুদ্ধ-  ব্রাহ্মণেরাই কি কেবল স্নানের মাধ্যমে শরীরের ময়লা দূর করতে পারে, অন্যান্য বর্ণরা পারে না?

আশ্বলায়ন- না, গোতম, চার বর্ণের মানুষই একাজ করতে পারে।

বুদ্ধ- তাহলে ব্রাহ্মণ বর্ণই শ্রেষ্ঠ ও অন্যান্য বর্ণ নিকৃষ্ট, একথার অর্থ কি? মনে কর,  কোনো সার্বভৌম চক্রবর্তী রাজা প্রত্যেক বর্ণের একশ জন পুরুষ একত্র করলেন এবং তাদের মধ্যে যারা ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও রাজকুলে জন্মেছে তাদের বললেন, ” ওহে তোমরা এদিকে এসো, শাল কিংবা চন্দনের মত উৎকৃষ্ট কাঠ নিয়ে অগ্নি উৎপন্ন কর; আর চণ্ডাল, নিষাদ প্রভৃতি হীনকুলে জন্ম নেওয়া মানুষদের বললেন, যে গর্তে কুকুরকে খেতে দেওয়া হয়, যে গর্তে শুকরকে খেতে দেওয়া হয় সেই গর্তে অথবা রঞ্জকের গর্তে এরগুর কাঠ দিয়ে অগ্নি উৎপন্ন কর। হে আশ্বলায়ন, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের মানুষরা উৎকৃষ্ট কাঠ দিয়ে যে আগুন জ্বালাবেন কেবল সেটিই কি উজ্জ্বল ও তেজপূর্ণ হবে,আর চণ্ডাল প্রভৃতি নিম্ন বর্ণের মানুষরা নিকৃষ্ট কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাবেন সেটি উজ্জ্বল ও তেজপূর্ণ হবে না? তুমি কি এমন মনে কর?

আশ্বলায়ন- হে গোতম, যে কোনো বর্ণের মানুষই হোক না কেন, সে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট যেকোনো কাঠ দ্বারা যেকোনো জায়গাতেই আগুন জ্বালাক না কেন, সর্ব স্থানেই আগুন সমান উজ্জ্বল ও তেজপূর্ণ হবে।

বুদ্ধ- কোনো ক্ষত্রিয়ের ছেলে যদি ব্রাহ্মণের কন্যাকে বিবাহ করে ও তাদের একটি ছেলে হয়, তাহলে ঐ ছেলেটি তার পিতামাতার মতই মানুষ হবে, একথা কি তোমার মনে হয় না? তেমনি কোনো ব্রাহ্মণ পুত্র যদি ক্ষত্রিয় কন্যাকে বিবাহ করে ও তাদের একটি ছেলে হয়, তাহলে সে কি পিতামাতার মত না হয়ে কিম্ভুতকিমাকার কোনো প্রাণী হয়? তুমি কি একথা মনে কর?

আশ্বলায়ন- এমন মিশ্র বিবাহে যে সন্তান হয়, তা পিতামাতার মতই মানুষ হয়ে থাকে। তাকে ব্রাহ্মণও বলা যেতে পারে, ক্ষত্রিয়ও বলা যেতে পারে।

বুদ্ধ- কিন্তু হে আশ্বলায়ন, একটি ঘোড়া ও গাধার মিলনের ফলে যে সন্তান হয়, তাকে কি তার মাতার মত কিংবা পিতার মত বলা যায়? তাকে কি ঘোড়াও বলে যেতে পারে, আবার গাধাও বলা যেতে পারে?

আশ্বলায়ন- হে গোতম, তাকে ঘোড়া কিংবা গাধা বলা যায় না। তা তৃতীয় কোনো জাতির হয়ে থাকে। তাকে আমরা খচ্চর বলি। কিন্তু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সম্পর্কের ফলে যে সন্তান জন্মে তার মধ্যে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায় না।

বুদ্ধ- হে আশ্বলায়ন, দুটি ব্রাহ্মণ ভাইয়ের মধ্যে যদি একজন বেদ অধ্যয়ণ করে ভালো পণ্ডিত হয় ও অপরজন অশিক্ষিত থেকে যায়, তাহলে তাদের মধ্যে কাকে ব্রাহ্মণরা শ্রাদ্ধ ও যজ্ঞে প্রথম নিমন্ত্রণ করবে?

আশ্বলায়ন- যে পণ্ডিত তাকে নিমন্ত্রণ করা হবে।

বুদ্ধ- এখন মনে কর, দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন বিদ্বান কিন্তু অত্যন্ত দুঃশীল কিন্তু অপরজন বিদ্বান নয় কিন্তু সুশীল, তাহলে তাদের মধ্যে প্রথম কাকে নিমন্ত্রণ করবে?

আশ্বলায়ন- হে গোতম, যে ব্যক্তি সচ্চরিত্র, তাকেই প্রথম নিমন্ত্রণ দেওয়া হবে। দুষ্ট ব্যক্তিকে দান করে কি কোনো মঙ্গল হয়?

বুদ্ধ- হে আশ্বলায়ন, তুমি প্রথমে ‘জাতিকে’ গুরুত্ব দিয়াছিলে, এরপর বেদাভ্যাসকে ও এখন ‘চরিত্রকে’ গুরুত্ব দিচ্ছ। অর্থাৎ আমি চাতুর্বর্ণে যে সংস্কার করতে চাই, তাই তুমি মেনে নিচ্ছ।

বুদ্ধের একথা শুনে আশ্বলায়ন মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। এরপর কি বলবেন তা আর ভেবে পেলেন না। অবশেষে আশ্বলায়ন বুদ্ধের ভক্ত হয়েছিলেন।

[সুত্তপিটক/ মজ্ঝিমনিকায়/ আশ্বলায়ন সূত্র]

এই সূত্রে অগ্নির দৃষ্টান্ত দিয়ে যেভাবে বুদ্ধ জাতিভেদকে খণ্ডন করলেন, একইরকম কথা সূত্তপিটকের মজ্ঝিমনিকায়ের কণ্ণকত্থল সুত্তে পাওয়া যাবে, সেখানেও বুদ্ধ অগ্নির দৃষ্টান্ত দিয়ে জাতিভেদের খণ্ডন করেছেন।

বুদ্ধের মতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভরদ্বাজ এবং বাসেট্ঠ শ্রমণ হয়েছিলেন। এর ফলে ব্রাহ্মণেরা তাদের নানাভাবে তিরস্কার করতো। ভরদ্বাজ ও বাসেট্ঠের সাথে কথোপকথনকালে একবার বুদ্ধ তাদের জিজ্ঞেস করেন, ব্রাহ্মণ হতে শ্রমণ হওয়ার ফলে ব্রাহ্মণেরা তাদের তিরস্কার করে কিনা! বাসেট্ঠ বুদ্ধকে জানান যে ব্রাহ্মণেরা তাদের নানা উপায়ে তিরস্কার করে। তিরস্কার করার সময় তারা ঠিক কি বলে তা বুদ্ধকে জানান বাসেট্ঠ। ব্রাহ্মণদের জাতিবাদী কথাগুলোর খণ্ডন করেন বুদ্ধ। আশ্বলায়ন সূত্রে ব্রাহ্মণেরা যেমন দাবী করেছেন এবং বুদ্ধ যেমন উত্তর দিয়েছেন, এই ক্ষেত্রেও ব্রাহ্মণদের একই রকম দাবীর একই ধরণের উত্তর দেন বুদ্ধ। [উৎস]

ক্ষমতা সকলের হাতেই থাকা উচিত

একসময় বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবনে অনাথপিণ্ডকের বাগানে অবস্থান করছিলেন। তখন এসুকারী নামে এক ব্রাহ্মণ তার কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ” হে গোতম, ব্রাহ্মণেরা চার রকমের পরিচর্যার কথা বলে। ব্রাহ্মণের পরিচর্যা চার বর্ণের লোকই করতে পারে, ক্ষত্রিয়ের পরিচর্যা ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই তিন বর্ণের লোকেদেরই কর্তব্য, বৈশ্যের পরিচর্যা বৈশ্য ও শূদ্র এই দুই বর্ণের লোকেই করবে এবং শূদ্রের পরিচর্যা কেবল শূদ্রই করবে, অন্য বর্ণের মানুষেরা কিভাবে তার পরিচর্যা করবে? এই পরিচর্যা বিষয়ে আপনার মত কি?”

বুদ্ধ- হে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণদের এই কথায় সবলোকের সম্মতি আছে কি? পরিচর্যা করতে হবে, এই কথা যারা বলে, তারা সাধারণ মানুষকে এমন কথা বলার অধিকার দিয়েছে কি?

এসুকারী- হে গোতম, না তেমন কিছু নয়।

বুদ্ধ- তাহলে যদি কোনো গরীব মানুষ মাংস খেতে না চায়, আর তার প্রতিবেশী জোর করে তার উপরে মাংসের এক ভাগ চাপিয়ে দেয় এবং বলে,’ তুমি এই মাংসটুকু খাও এবং আমাকে এর দাম দাও।’ তাহলে যেমন বলতে হয়, প্রতিবেশী জোর করে তার ঘাড়ে মাংস চাপাল, তেমনি ব্রাহ্মণরা সর্ব সাধারণের উপর এই পরিচর্যাগুলো চাপিয়েছে, এমনই বলতে হবে। আমার কথা হল, যে কোনো বর্ণের মানুষই হোক না কেন, তারা বিবেচনা করবে কার পরিচর্যা করলে তাদের কল্যাণ কিংবা অকল্যাণ হবে এবং তারা তারই পরিচর্যা করবে। চার বর্ণের বিবেচক লোকদের জিজ্ঞেস করলে তারা এরকম কথাই বলবে। উচ্চকুলে, উচ্চবর্ণে কিংবা ধনীর বংশে জন্মগ্রহণ করা ভালো কিংবা মন্দ তা আমি বলি না। যে ব্যক্তি উচ্চকুলে, উচ্চবর্ণে কিংবা ধনীর বংশে জন্মগ্রহণ করেছে, সে যদি প্রাণীহত্যা প্রভৃতি পাপ করতে থাকে, তাহলে তার এই কুলীনতাকে ভালো বলা যায় না। কিন্তু সে যদি প্রাণীহত্যা প্রভৃতি পাপ হতে বিরত হয় তাহলে তার কুলীনতা খারাপ নয়। যে মানুষের পরিচর্যা করলে শ্রদ্ধাশীল, বিদ্যা, ত্যাগ ও প্রজ্ঞা এসবের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, তাদের পরিচর্যা করবে, এটাই আমার মত।

এসুকারী- হে গোতম, ব্রাহ্মণেরা চারটি ধনের কথা বলে থাকে। ভিক্ষা করা ব্রাহ্মণের ধন, ধনুর্বাণ ক্ষত্রিয়দের ধন, চাষবাস ও গোরক্ষা বৈশ্যদের ধন এবং কাস্তে ও ঝাঁকা শূদ্রদের ধন। প্রহরী যদি চুরি করে তাহলে সে যেমন কর্তব্যচ্যুত হয়, তেমনি চারবর্ণের মানুষেরা যদি নিজের ধনের উপর অবহেলা করে তাহলে সেই ব্যক্তি নিজ কর্তব্য হতে বিচ্যুত হবে। এই বিষয়ে আপনার মত কি?

বুদ্ধ- হে ব্রাহ্মণ, এই চারটি ধনের কথা বলার অধিকার মানুষেরা ব্রাহ্মণদের দিয়েছে কি?

এসুকারী- না গোতম, দেয়নি।

বুদ্ধ- তাহলে যে গরীব ব্যক্তি মাংস খেতে চায় না, তার উপর মাংসের ভাগ চাপিয়ে তার মূল্য দাবী করা যেমন, ব্রাহ্মণদের এই কাজটি তেমনই বলে বুঝতে হবে। হে ব্রাহ্মণ, আমার কথা এই যে, আর্য শ্রেষ্ঠ ধর্মই সকলের নিজস্ব ধন। ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারকুলে জন্মগ্রহণ করা মানুষদের যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বলা হয়। একথা বলা কাঠ, শকলিকা, তৃণ ও ঘুঁটে এই চার পদার্থ থেকে উৎপন্ন অগ্নিকে কাষ্ঠাগ্নি, শকলিকাগ্নি, তৃণাগ্নি ও গোময়াগ্নি বলার মতনই। কিন্তু এই চারকুলের মানুষ যদি প্রাণিহত্যা প্রভৃতি পাপ হতে দূরে থাকে তাহলে তাদের মধ্যে শুধু ব্রাহ্মণই মৈত্রীভাবনা পোষণ করতে সমর্থ হবে আর অন্যান্য বর্ণের লোকেরা মৈত্রীভাবনা পোষণ করতে পারবে না, তুমি কি এমনটা মনে কর?

এসুকারী- হে গোতম, না, আমার সেরকম মনে হয় না।

বুদ্ধ- শুধু ব্রাহ্মণই নদীতে গিয়ে সাবান দিয়ে স্নান করে নিজের শরীরের ময়লা দূর করতে পারবে কিন্তু অন্য বর্ণের লোকেরা তা পারবে না, তুমি কি তা মনে কর?

এসুকারী- হে গোতম, না, আমার তেমন মনে হয় না। চার বর্ণের লোকই নদীতে গিয়ে সাবান দিয়ে স্নান করে নিজের শরীরের ময়লা দূর করতে পারবে।

বুদ্ধ- তেমনি হে ব্রাহ্মণ, প্রত্যেক কুলের লোকই তথাগতের উপদেশ অনুসারে চলে ন্যায্য ধর্মের আরাধনা করতে পারবে।

[সুত্তপিটক/ মজ্ঝিমনিকায়/এসুকারী সুত্ত]

তারা সকলেই বুদ্ধের পুত্র

বুদ্ধ তার সংঘে জাতিভেদের কোনো স্থান দেন নি। বুদ্ধ বলেতেন, ” হে ভিক্ষুগণ, গঙ্গা, যমুনা, অচিরবতী, সরযু, মহী এই মহানদীগুলো মহাসমুদ্রে মিলিত হলে নিজ নিজ নাম ত্যাগ করে যেমনি মহাসমুদ্র নাম প্রাপ্ত হয়, তেমনি ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণ তথাগতের সংঘে প্রবেশ করলে পূর্বের নাম, গোত্র পরিত্যাগ করে ‘শাক্যপুত্রীয় শ্রমণ এই এক নামে পরিচিত হয়।” [উদান ৫/৫ ও অঙ্গুত্তরনিকায় অট্ঠকনিপাত]

একইপ্রকার কথা ত্রিপিটকের অন্যত্রও আছে। বুদ্ধ ব্রাহ্মণ থেকে শ্রমণ হওয়া বাসেট্ঠকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “বাসেট্ঠ, তোমরা নানাজাতি, নানানাম, নানা গোত্রবিশিষ্ট, নানাকুল থেকে গৃহত্যাগ করে তোমরা গৃহহীন প্রব্রজ্যা আশ্রয় করেছ। যদি তোমরা জিজ্ঞাসিত হও “তোমরা কে?” তাহলে “আমরা শাক্যপুত্রীয় শ্রমণ” এরূপ উত্তর দেবে।” [উৎস]

কুলের তোয়াক্কা না করে বুদ্ধ অঙ্গুত্তরনিকায়ের বচ্ছপুত্র সূত্রে বলেছেন, “পশুর পালে সাদা, কালো, লাল, তামাটে , রঙ বেরঙের বা একই রঙের অনেক পশু থাকে। যে পোষা ষাঁড় ভারবাহী, শক্তিমান, সুন্দর ও দ্রুতগামী তাকেই মানুষ ভার বহন করার জন্য যোয়াল দেয়, এর রঙ বিচার করে না। তেমনি মানুষ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, চণ্ডাল, পুক্কস যে কুলেই জন্ম নিক না কেন, সে যদি দান্ত, ধর্মনিষ্ঠ, ন্যায়বান, শীলবান, সত্যবাদী, কর্মনিষ্ঠ, ব্রহ্মচর্য অবলম্বনকারী হয়, তাহলে তাকেই দান করা উচিত।”

বুদ্ধের কাছে যে জাতির গুরুত্ব নেই তা তিনি বহুবারই বলেছেন। বুদ্ধের জাতিভেদের বিরোধীতা কেবল কথাতে সীমিত ছিল না, কাজেও তা দেখা গিয়েছিল। দীক্ষা দেওয়ার সময় বুদ্ধ কখনোই কারো জাতি-কুল বিচার করেননি। তিনি যেমন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের দীক্ষিত করেছিলেন, তেমনি পতিতা, চণ্ডাল প্রভৃতি সমাজের অবহেলিত মানুষেরাও তার করুণা লাভ করেছিল। তার ঔদার্যেই পতিতা আম্রপালি ভিক্ষুণিদের শিরোমণি হয়েছিলেন, চণ্ডাল হয়েও স্থবির শীলবান সকল মানুষের পূজনীয় হয়েছিলেন। সুনীত অস্পৃশ্য ছিলেন কিন্তু বুদ্ধ তাকে আপন করে নিয়েছিলেন। সুনীত তার অবস্থার কথা বর্ণনা করে বলেছেনঃ

“আমি নীচকুলে দরিদ্র ও অনশনক্লিষ্ট হয়ে জন্মগ্রহণ করি। আমার কাজ ভীষণ হীন ছিল, ফুল প্রভৃতি আবর্জনা পরিষ্কার করতাম। মানুষের পক্ষে যা ঘৃণ্য, অবজ্ঞার, তিরস্কৃত কাজ তা আমি করতাম, নিজেকে খুব ছোট মনে করতাম, সবাইকে দেখামাত্র আমার প্রণাম করতে হত। একদিন ভিক্ষুসংঘ পরিবৃত বুদ্ধকে দেখলাম, তিনি তখন মগধ রাজ্যে প্রবেশ করছিলেন। এমন সময় আমার ভারখানা রেখে তাকে বন্দনার জন্য অগ্রসর হলাম। পুরুষোত্তম আমার প্রতি দয়া করে দাঁড়ালেন। সেই সর্বলোকের করুণাধার কারুণিক শাস্তা আমাকে ‘এসো ভিক্ষু’ বলে আহ্বান করলেন, তাতেই আমার উপসম্পদা হল। তখন থেকেই আমি জিনরাজের উপদেশ অনুসারে সাধনায় রত হই। ” [থেরীগাথা, দ্বাদশক নিপাত, ২. সুনীত স্থবির]

ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ, একথা একটা বুলি মাত্র

বুদ্ধের শিষ্যরাও বুদ্ধের কাছ থেকে সাম্যের শিক্ষা পেয়েছিলেন। বুদ্ধের মৃত্যুর পরে ঘটা অনেক ঘটনায় বুদ্ধশিষ্যদের জাতিভেদের কঠোর বিরোধীতা করতে দেখা যায়।

একসময় আয়ুষ্মান মহাকচ্চান মথুরার নিকটে বৃন্দাবনে অবস্থান করছিলেন। মথুরার রাজা অবন্তিপুত্র মহাকচ্চানের কীর্তি শুনেছিলেন। তাই অনেক লোকজনকে সাথে নিয়ে তিনি তার কাছে উপস্থিত হলেন। অবন্তিপুত্র মহাকচ্চানকে জিজ্ঞেস করলেন, ” হে কাত্যায়ণ, ব্রাহ্মণ বর্ণই শ্রেষ্ঠ, অন্য বর্ণ হীন, ব্রাহ্মণ বর্ণই শুক্ল, অন্য বর্ণ কৃষ্ণ; ব্রাহ্মণরাই মুক্তি পায়, অন্য বর্ণ পায় না; ব্রাহ্মণ ব্রহ্মদেবের মুখ হতে উৎপন্ন হয়েছে এবং ব্রাহ্মণরা ব্রহ্মদেবের ঔরসপুত্র- ব্রাহ্মণরা এসব কথা বলে থাকেন। এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

কাত্যায়ণ- হে মহারাজ, এটা শুধুমাত্র একটা বুলি। মনে করুন, কোনো ক্ষত্রিয় ধনধান্যে কিংবা রাজ্যে সমৃদ্ধ হল, তাহলে চার বর্ণের মানুষই কি তার সেবা করবে না?

রাজা- হে কাত্যায়ণ, চার বর্ণের লোকই তার সেবা করবে।

কাত্যায়ণ- তেমনি অন্য কোনো বর্ণের মানুষও যদি ধনধান্য ও রাজ্যে সমৃদ্ধ হয় তাহলে চার বর্ণের লোকেরাই কি তার সেবা করবে না?

রাজা- চার বর্ণের লোকই তার সেবা করবে।

কাত্যায়ণ- তাহলে চার বর্ণের মানুষই সমান বলে প্রমাণিত হল, তাই নয় কি?

রাজা- এভাবে দেখলে চার বর্ণের মানুষেরাই পরস্পর সমান। তাদের মধ্যে কোনো ভেদ আমার চোখে পড়ছে না।

কাত্যায়ণ- এই জন্যই আমি বলি যে, ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ বর্ণ, ব্রাহ্মণদের এই মত কেবল একটা বুলি। ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের লোকই যদি প্রাণিহত্যা প্রভৃতি পাপ করে তাহলে তাদের একই রকম দুর্গতি হবে, মহারাজ কি এমন মনে করেন না?

রাজা- চার বর্ণের মধ্যে যেকেউ কোনো পাপ করলে সমান দুর্গতি প্রাপ্ত হবে।

কাত্যায়ণ- আচ্ছা মহারাজ, এমন অবস্থায় চার বর্ণই সমান বলে আপনার মনে হচ্ছে না কি?

রাজা- এভাবে দেখলে চার বর্ণের মানুষেরাই পরস্পর সমান। তাদের মধ্যে কোনো ভেদ আমার চোখে পড়ছে না।

কাত্যায়ণ- চার বর্ণের মধ্যে যেকোনো বর্ণের মানুষ যদি প্রাণীহত্যা প্রভৃতি পাপ থেকে বিরত থাকে তাহলে তাদের মধ্যে কেউ কি স্বর্গে যাবে না?

রাজা- এদের সকলেই স্বর্গে যাবে বলে আমার মনে হয়।

কাত্যায়ণ- এই জন্যই আমি বলে থাকি, ব্রাহ্মণ বর্ণই শ্রেষ্ঠ, একথা কেবলই একটা বুলি। হে মহারাজ, মনে করুন, আপনার রাজ্যের চার বর্ণের মধ্যে কোনো বর্ণের মানুষ যদি সিঁধকাটা, লুঠকরা, পরস্ত্রীগমন প্রভৃতি অপরাধ করে এবং রাজপুরুষেরা তাকে ধরে আনে, তাহলে আপনি তাকে যথাযোগ্য শাস্তি দেবেন কি?

রাজা- সে যদি বধের যোগ্য হয়, তাহলে আমি তাকে বধ করব। যদি সে জরিমানার যোগ্য হয়, তবে তাকে জরিমানা করা হবে। আর সে যদি নির্বাসনের যোগ্য হয়, তাহলে তাকে দেশ থেকে বের করে দেব; কেননা এখন সে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য বা শূদ্র নয়, সে কেবলই একজন অপরাধী।

কাত্যায়ণ- তাহলে চার বর্ণই সমান নয়কি?

রাজা- এভাবে দেখলে চার বর্ণকেই সমান বলে মনে হয়।

কাত্যায়ণ- মনে করুন, চার বর্ণের মধ্যে কোনো এক বর্ণের মানুষ পরিব্রাজক হল এবং সদাচার পালন করতে থাকল। তাহলে আপনি তার সাথে কেমন ব্যবহার করবেন?

রাজা- আমি তাকে বন্দনা করব, তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেব ও তার প্রয়োজনীয় অন্নবস্ত্র প্রভৃতির ব্যবস্থা করে দেব, কারণ সে এখন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র নয়, সে এখন কেবলই শ্রমণ নামে পরিচিত।

কাত্যায়ণ- তাহলে কি চার বর্ণই সমান বলে প্রমাণিত হল না?

রাজা- এইভাবে দেখলে চার বর্ণকেই সমান বলে মনে হয়।

কাত্যায়ণ- এইজন্যই আমি বলি, ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ, একথা কেবলই একটা বুলি।

রাজা- হে কাত্যায়ণ, আপনার উপদেশ খুবই সুন্দর, যেমন উপুর করা পাত্র কেউ সোজা করে রাখে, কেউ ভুল রাস্তায় হারিয়ে গেলে যেমন কেউ তাকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দেয়, অন্ধকারে মানুষ দেখতে না পেলে যেমন কেউ মশাল জ্বেলে দেয়, তেমনি মাননীয় কাত্যায়ণ অনেকভাবে আমাদের ধর্মোপদেশ দিলেন। এইজন্য আমি মাননীয় কাত্যায়ণের, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণ নিচ্ছি। আমি আজ হতে মৃত্যু পর্যন্ত আপনার ভক্ত হলাম।

কাত্যায়ণ- মহারাজ, আমার শরণ নেবেন না। আমি যে ভগবানের আশ্রয় নিয়েছি সেই ভগবানের আশ্রয় আপনি নিন।

রাজা- হে কাত্যায়ণ, সেই ভগবান কোথায় আছেন?

কাত্যায়ণ- সেই ভগবান পরিনির্বাণ লাভ করেছেন।

রাজা- সেই ভগবান যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে আমরা তার দর্শনের জন্য শত যোজন দূরে হলেও যেতাম। কিন্তু তিনি পরিনির্বাণ লাভ করলেও আমরা সেই ভগবানের আশ্রয় নিচ্ছি, তার ধর্ম ও ভিক্ষু সংঘের আশ্রয় নিচ্ছি। আজ হতে মৃত্যু পর্যন্ত আমি তাদের শরণাগত উপাসক হলাম।

[সুত্তপিটক/ মজ্ঝিমনিকায়/মধুরসুত্ত]

জাতিভেদের করাল গ্রাস

উল্লেখিত দৃষ্টান্তগুলোর দ্বারা সহজেই বোঝা যায় যে, বৌদ্ধভারতে জাতিভেদের বিরুদ্ধে বুদ্ধ এবং তার ভিক্ষুরা বেশ বলিষ্ঠ আওয়াজ তুলেছিলেন। বুদ্ধের ধম্ম জাতিভেদের নিষ্পেষণ থেকে অনেক নিপীড়িতকেই মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধের পূর্বেই জাতিভেদ জেঁকে বসেছিল, ভারতের নানান প্রান্তকে জাতিভেদ গ্রাস করে নিয়েছিল। তাই বুদ্ধ এবং বৌদ্ধদের এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ হতে জাতিভেদ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। পরিশেষে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের অবনতি ভারতবর্ষকে আরো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়।

সহায়ক গ্রন্থঃ ১) ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটি বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ত্রিপিটক ২) ভগবান বুদ্ধ- ধর্মানন্দ কোসম্বী

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ লেখাটিতে ধর্মানন্দ কোসম্বীর ‘ভগবান বুদ্ধ’ বইটির ভীষণ রকম সহায়তা নেওয়া হয়েছে। এই লেখার একটা বড় অংশ কেবলমাত্র কোসম্বীর গ্রন্থের লেখার সাধু থেকে চলিততে রূপান্তর। তাই কোসম্বীর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা পোষণ করছি।

প্রবন্ধ সম্পাদনায় ও লেখনীতে: শুদ্ধবুদ্ধি

মূল লেখা আপডেট পেতে নিম্নোলিখিত লিংক প্রযোজ্য

https://thehinduwebsite.wordpress.com/2021/02/12/%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%af%e0%a7%87%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a7%87-%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a7%87%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ac/


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ