১) মাতৃতন্ত্রের ক্রম
ঐতিহাসিকদের মতে, ৫/৬ হাজার বছর আগেও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চালু ছিল।
একসময় মানুষ শিকারী ও সংগ্রাহক জীবন যাপন করতো। নারী পুরুষের বনের পশু শিকার ও ফল মূল সংগ্রহ করেই জীবন চলতো। কাজের ক্ষেত্রে সমতা ছিল, তাই সমাজেও সমতা থাকার কথা! কিন্তু মেয়েদের আর একটা বড় দায়িত্ব পালন করতে হত, সন্তান পালন করতে হত। অন্যান্য পশুদের বাচ্চা জন্মের সাথেই প্রায় চলতে ফিরতে শিখে যায়, কিন্তু মানুষের বাচ্চা জন্মের পরও খুব অসহায় থাকে, তাই তার মায়ের সান্নিধ্যের দরকার হয়। মা যেহেতু এই বাড়তি দায়িত্বটি পালন করতেন তাই আদিম শিকারী সমাজেও ছিল মায়েরই কর্তৃত্ব তারপর, একটা সময় মানুষ বল্লমের আবিষ্কার করে।আর ওই বল্লম নিয়ে পশুশিকার ও পুরুষের সাথে পাল্লা দেয়া স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এছাড়াও সন্তানদের দেখাশোনাও করতে হত। তাই বল্লমের আবিষ্কারের পর থেকে সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হয়ে পড়ে।
শিকারী সমাজ যাযাবর ছিল, খাবারের সন্ধানে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হত। মানুষের জীবনে বিপ্লব নিয়ে এল কৃষিকাজ।সংগ্রাহক থেকে মানুষ হল উৎপাদক। মানুষ গড়ে তুললো সভ্যতা।তার যাযাবর জীবনের অবসান হল। সকল জমি কৃষির উপযোগি ছিলনা বলে উপযুক্ত স্থানে বসতি গড়লো মানুষ। নদীতীরে উর্বর ভূমিতে কত যে সভ্যতা গড়েছে মানুষ! এখন আর খাদ্যের অনিশ্চয়তা নেই, বছরের নির্দিষ্ট কয়েক মাস ফসল ফলালেই সারাবছর নিশ্চিন্তে কাটানো যায়।তাই মানুষ যোগ দিতে পারলো নানান সৃজনশীল কাজে, বস্ত্র শিল্প, মৃৎশিল্প, ঘট তৈরি,ঘর তৈরি, আরও কত রকমের কাজে। এইসবও কাদের আবিষ্কার? আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এসবও মেয়েদের আবিষ্কার।
শিকারি সমাজ স্থিতিশীল, অপরিবর্তনশীল, আর কৃষিজীবি সমাজ গতিশীল, সভ্যতার জন্মদাতা। যখন সমাজ থেমে গেছিল তখন মেয়েরাই সমাজকে গতিশীলতা দিয়েছে।তাই কৃতিত্ব মায়েদেরই।
এরপর কৃষির পরের যুগে যখন কৃষিতে ভূমি কর্ষণের জন্য লাঙ্গলের সাথে পশু ব্যবহার করা হতে লাগলো, সেই সমাজ হয়ে পড়লো পুরুষের অধীন। সেই সময় থেকে আজো পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা চলছে প্রায় সকল স্থানে।
২) মাতৃতন্ত্রের প্রকৃতি
পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় যেমন সম্পত্তি পুরুষদের কাছেই থাকে তেমনি মাতৃতন্ত্রেও সম্পত্তি নারীদের হাতে থাকতো।
পিতৃতন্ত্রে সন্তানেরা বাবার গোত্র, পরিচয় পায়। মাতৃতন্ত্রে সন্তানেরা মায়ের পরিচয় পায়, এক্ষেত্রে পিতা আগন্তুকের মতো।পিতৃতন্ত্রে ধর্ম পুরুষ দেবতায় পূর্ণ অথবা দেবমন্ডলে তাদেরই আধিপত্য, তেমনি মাতৃতন্ত্রেও দেবমন্ডলে দেবীর আধিপত্য। ( সিন্ধুর মাতৃকাদেবীর অথবা প্রাক আর্যধর্মের কথা ভাবা যেতে পারে)
উদাহরণ: বর্তমানে খুব কম সমাজেই মাতৃতন্ত্র টিকে আছে, তবে ভারতের পূবের খাসিয়ারা এইক্ষেত্রে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। খাসিয়া সমাজ কৃষিনির্ভর, চাষে হালবলদের চলন নেই। তাই আদিম অবস্থার কারণে মাতৃতন্ত্র এখনো টিকে রয়েছে।
এই সমাজে মা-ই প্রধান। মার পরিচয়, বংশেই সন্তান পরিচিত হয়। এই সমাজে বাবা যেন অনাত্মীয় বাইরের মানুষ। মানুষ মারা যাবার পর সন্তানদের তার মায়ের কবরের পাশে গোর দেয়া হয়, আর স্বামীর গোর হয় তার মায়ের কবরের পাশে। পিতা ও সন্তানদের কবর হয় আলাদা জায়গায়। একই কবরখানায় স্ত্রী পুরুষের কবর থাকলেও মহিলাদের কবর থাকে সামনের দিকে আর পুরুষদের পিছনের দিকে। এদের ধর্মে দেবতাদের চেয়ে দেবীদের গৌরব বেশি। হবেই বা না কেন? আসলে দেবতার কল্পনা তো মানুষই করে থাকে।পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ দেবতার প্রাধান্য, আর মাতৃতন্ত্রে দেবীদের।
আবার শাসনক্ষেত্রেও মেয়েরা প্রধান। রাজা নয় রানিই শাসন করেন। রাজা যেন পাশে গোলামের মত চুপটি করে বসে থাকেন। রাজ্য পায় রাজকন্যা, রাজপুত্র কিচ্ছুটি পায়না।ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করেন পুরুষ পুরোহিত, কিন্তু মেয়ে পুরোহিতের অনুপস্থিতিতে তিনি কিছু করতে পারেন না।
৩) মাতৃতন্ত্রের কেন্দ্র
চীনের দক্ষিণে সুমু নামের জাতির মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল, শাসনক্ষমতা থাকতো রানীর হাতে। গ্রানেট নামের পন্ডিত বলেছেন, প্রাচীনকালে সমগ্র চীন ছিল মেয়েদের শাসনের অধীনে।
সুমেরিয়ায় বিখ্যাত পুরোহিত শাসক ছিল লুগালনাভা, তার স্ত্রী বরনমটররা বিখ্যাত ছিলেন স্বামীর সাথে মিলিত ভাবে নগর পরিচালনার জন্য। স্বামীর মত স্ত্রীরও নিজস্ব দরবার ছিলো।
ভারতের প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পা মহেঞ্জোদারো কেন্দ্রগুলি থেকে এক ধরণের মূর্তি পাওয়া যায়, যাদের বসুমাতা মূর্তি (মাতৃকাদেবী) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এখানেও প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার ছাপ পাওয়া যায়।
৪) মাতৃতন্ত্রে ভাঙ্গন
কালের আবর্তনে আজ কয়েক হাজার বছর মাতৃতন্ত্র নেই। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পিতৃতন্ত্র।তাতে নারী নির্যাতিত হয়েছে এবং হচ্ছে এবার সাম্যের দিকে এগোনোর সময়। এক পায়ে মানুষ যেমন দাঁড়াতে পারে না, তেমনি নারীর উত্থান ছাড়া সভ্যতাও পূর্ণ নয়। পুরুষের নিজের খাতিরেই, সভ্যতার উন্নতির জন্যই উচিত নারীমুক্তির কাজে সাহায্য করা, যাতে করে নারী-পুরুষ দুজন মিলে সমাজকে সমানভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
প্রবন্ধ সম্পাদনায় ও লেখনীতে: শুদ্ধবুদ্ধি
মূল লেখা আপডেট পেতে নিম্নোলিখিত লিংক প্রযোজ্য
https://thehinduwebsite.wordpress.com/2017/12/10/sei-jugey-mayera-boro/
0 মন্তব্যসমূহ