ব্যাটারি চালিত দ্বিচক্রযান - মিথ ও সত্য।।রাণা

 


ব্যাটারি চালিত যেকোন গাড়ির আগে 'ই' শব্দ জোড়ে। 'ই' মানে ইলেকট্রিক। স্কুটি হলে ই-স্কুটি, বাইক হলে ই-বাইক। চার চক্রযানের আলোচনায় ঢুকছি না। কারণ এর দাম জ্বালানি গাড়ির চেয়ে  প্রায় দশগুণ। যা আমাদের সাধ ও সামর্থ্যের বাইরে।

ই-স্কুটি কিনবেন?

প্রথমে এরকম অনেক প্রত্যক্ষদর্শী পেয়ে যাবেন, যারা জানাবে, অমুকবাবুর ব্যাটারি মাঝ রাস্তায় শেষ হয়ে গেছিল। ওনাকে ঠেলে ঠেলে আনতে হয়েছে। একটু ভিতরে ঢুকলে বুঝবেন, সেই পুকুরপাড়ে ভূত দেখার মত। দেখেছে সবাই, কিন্তু কেউ দেখেনি। ওর বন্ধু, ওর বাবার বাবা....সঠিক প্রত্যক্ষদর্শী মেলা ভার।

ই-যান কিভাবে চলে?

ই-যান চলে ইলেকট্রিকে। চাকা ঘোরে ডিসি মোটরে। ডিসি শক্তি ব্যাটারি থেকে সরবরাহ হয়। বাড়ির ফ্যান যেমন মোটরে ঘোরে, অনেকটা তেমন। শুধু নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। জ্বালানি গাড়িতে ইঞ্জিন চলে খনিজ তেলের সাহায্যে।

ই-যান কি পরিবেশ বান্ধব?

অবশ্যই। এর থেকে কোন ধোঁয়া বের হয় না। ই-স্কুটি ব্যাটারি একবার চার্জ করতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার হয়, তা উৎপাদন করতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫০০ গ্রামের মত কয়লা লাগে। শহরের পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ জীবাশ্ম তেল জাত গাড়ি।

ই-স্কুটি কি ধীরগতি যান?

আজ থেকে দশবছর আগের ব্যাটারি গাড়ির কথা ভুলে যান। তখন ঘন্টায় গড় গতি ছিল ১০-১৫ কিমি। এখন তা ভুলে যান। ৬০ থেকে ৬৫ হাজারের ই-স্কুটিতে সর্বোচ্চ গতি ৪০-৫০ কিমি। পকেট ভারি থাকলে ৬০-৬৫ অব্দি গতি পেতে পারেন।

ব্যাটারির চার্জ কি মাঝপথে শেষ হয়ে যায়?

ব্যাটারি গাড়ি আপনার মোবাইল ফোন নয়, যে মাঝপথে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেলে, পকেটে করে নিয়ে আসবেন। যারা ব্যাটারি গাড়িতে অভ্যস্ত তারা ঠিক বেরনোর আগে গাড়ির স্ক্রিনে কতটা ব্যাটারি আছে দেখে নেন এবং কতটা পথ গিয়ে ফিরে আসতে হবে তাও জানাটা জরুরি। এখন সাধারণত এক চার্জে ৫০-৬০ কিমি যাওয়া যায়। খরচ আরো একটু বেশি করলে তা ৯০ কিমি অব্দি হতে পারে। তবু বলব, আপনার মোবাইলের ব্যাটারি দেখে যেমন বুঝতে পারেন কতক্ষণ চলবে, নিজের গাড়ির ক্ষেত্রেও সে ধারণা আসবে। সবসময় ৩০% ব্যাটারি রিজার্ভ হিসেবে রাখুন, কোনদিন বিপদে পড়বেন না।

গাড়ি চার্জ করার জন্য কি বাড়ির বিদ্যুৎ খরচ খুব বেশি হয়? 

গড় হিসেবে একটা সাধারণ গাড়ি এক চার্জে ৫০ কিমি যায়। গাড়ি একবার চার্জ করতে সর্বোচ্চ ২ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। অর্থাৎ ১৫ টাকায় ৫০ কিমি। জ্বালানি যানে যে খরচ এখন একশ টাকার মত। সাথে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ধরতে হবে। ব্যাটারি যানে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রায় শূন্য। বাড়ির ফ্যান শেষ কবে সার্ভিস করিয়েছেন? ঠিক তেমনভাবে গাড়ির প্রতি সঠিক যত্ন নিলে সার্ভিস খরচ প্রায় শূন্য।

ব্যাটারি নাকি ২ বছর অন্তর পাল্টাতে হয়?

ব্যাটারি কোন কোম্পানির ব্যবহার করছেন, ব্যাটারি কিনতে কত খরচ করছেন, ব্যাটারি চার্জিং ঠিকভাবে অনুসরণ করছেন কিনা, তার উপরে ব্যাটারির জীবনীশক্তি নির্ভর করে।

কয়েকটা জিনিস অবশ্যই মেনে চলুন, তাতে ব্যাটারি ৩-৫ বছর অব্দি নিশ্চিন্তে চলবে,

১) ব্যাটারি কিনতে একটু খরচ করুন, নামী কোম্পানি থেকেই কিনুন।

২) ব্যাটারি উৎপাদকের পরামর্শ অনুযায়ী চার্জার কিনুন। প্রত্যেক কোম্পানির ব্যাটারির চার্জিং পদ্ধতি আলাদা, তাই ৫০০ টাকা কম বলে অন্য কারো চার্জার না কেনা ভালো।

৩) ব্যাটারি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখবেন না। লক্ষ্য রাখুন ব্যাটারি সম্পূর্ণ চার্জ অবস্থায় থাকে। নাহলে ব্যাটারির জীবনীশক্তি দ্রুত কমতে থাকে।

৪) ব্যাটারিকে কখনোই সম্পূর্ণ ব্যবহার করবেন না। ৬০-৭০% ব্যবহৃত হওয়ার পরেই ব্যাটারিকে চার্জ দিন।

৫) তা বলে রোজ ২০-৩০% খরচ হয় বলে রোজ চার্জ দেবেন না। এ ক্ষেত্রেও ব্যাটারির জীবনীশক্তি (লাইফ সাইকেল) কমতে থাকে। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি হলে এই সতর্কতা রাখতেই হবে।

এখন ই-যানে ব্যাটারির উপরে সাধারণত তিন বছরের (অথবা কিলোমিটারের উপরে) ওয়ার‍্যান্টি বা গ্যারান্টি থাকে। একটু সঠিক ব্যবহৃত হলে ৫ বছর বা তার বেশি চলতেই পারে।

কোন ধরনের ব্যাটারির গাড়ি নেওয়া উচিত? 

সবটাই পকেট ও প্রয়োজনের উপরে। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির খরচ সাধারণ লেড(সীসা)-অ্যাসিড ব্যাটারির থেকে বেশি। প্রায় দশ হাজার অব্দি দামের পার্থক্য হতে পারে। 

যদি সামর্থ্য থাকে তবে লিথিয়াম ব্যাটারি নেওয়ায় বুদ্ধিমানের,  তাতে সুবিধা হবে,

১) ব্যাটারি বেশিদিন চলবে

২) ব্যাটারি হাল্কা, ফলে গাড়ির গতি সামান্য হলেও বেশি হবে

৩) ৪-৫ ঘন্টায় সম্পূর্ণ চার্জ হতে পারে। যেখানে লেড ব্যাটারি প্রায় ৮ ঘন্টা বা তার বেশি নেয়। আর কিছুদিনের মধ্যে গাড়ির লিথিয়াম ব্যাটারি সাধ্যের দামের মধ্যে আধ ঘন্টায় সম্পূর্ণ চার্জ হতে পারে। 

৪) লিথিয়াম ব্যাটারির দাম বর্তমানে বেশি হলেও ২০৩০ সালের মধ্যেই ব্যাটারির দাম অনেকটাই কমে যাবে। এর প্রধান কারণ সরকারি সহায়তা ও বৃহৎ কোম্পানিগুলো এই ব্যাটারি তৈরিতে উৎসাহী হওয়া। ফলে প্রতিযোগিতার কারণে এর দাম আরো কমবে।

তারপরেও যে মূল অসুবিধা রয়ে গেছে,

১) ব্যাটারির চার্জের জন্য রাস্তায় চার্জিং স্টেশন তৈরি হয়নি। ফলে নির্ধারিত গন্তব্যের বাইরে অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে হবে। কারণ ব্যাটারি চার্জ হবে বাড়িতে এসেই।

২) যেহেতু বিদ্যুৎ চালিত যান। অতএব জল সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে। বাড়ির ফ্যান, টিভি যেমন জলে ডুবিয়ে রাখতে পারেন না। গাড়ির মোটর থাকে পিছনের চাকায়। কোম্পানিরা দাবি করে যে সম্পূর্ণ জল নিরোধী। তবুও দেড় ফুট বা তার বেশি জলের মধ্যে চালালে গাড়ি খারাপ হতে পারে।

গাড়ি কেনার সময় যা মাথার মধ্যে রাখবেন?

১) কী উদ্দেশ্যে কিনছেন? 

২) বাড়ি থেকে গন্তব্য কত দূরত্ব? যেমন, আপনার যদি রোজের গন্তব্য ১৫-২০ কিমি হয়, তবে একটু কম খরচে ভালো গাড়ি পেতে পারেন। সেখানে অনেক বেশি খরচ করে বেশি মাইলেজের দরকার নেই।

৩) ব্যাটারির অ্যাম্পিয়ার আওয়ার (AH) কত?

৪) লিথিয়াম না লেড এসিড ব্যাটারি? সেই আলোচনা আগেই করেছি।

৫) কোন কোম্পানির কিনছেন? গুগল বাবা আছে, ইউটিউব আছে। কেনার আগে বারেবারে দেখুন। খরিদ্দারদের রিভিউ পড়ুন।

সবশেষে যেটা বলব, পৃথিবীর সমস্ত বড় কোম্পানি ব্যাটারি গাড়ির উপরে বাজি ধরেছে, সে জাপানের হোক বা আমেরিকার বা ভারতের। ভারতে টাটা, আম্বানি, বাজাজ, হিরো সহ সমস্ত বৃহৎ কোম্পানি এই ব্যবসাকে পাখির চোখ করেছে। ওলা তামিলনাড়ুতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ই-স্কুটি উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে চলেছে। যার বার্ষিক উৎপাদন এক কোটি অব্দি হতে পারে। ভারত সরকারও চাইছে ২০৩০ সালের মধ্যে রাস্তার সমস্ত গাড়ি হোক ব্যাটারি চালিত।

তাই আজ না হোক কাল আপনার গ্যারাজে ব্যাটারি গাড়ি থাকবে।

এখন না কিনতে চাইলে, এর মাঝের সময়টুকুতে এই নিয়ে আরো জানতে থাকুন, যাতে যুগের সাথে পিছিয়ে না পড়েন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ